আবদুল কুদ্দুস রানা •
কক্সবাজার শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খাজা মঞ্জিল পাহাড়ের ঢালুতে টিনশেডের একটি ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে থাকেন মহেশখালীর বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক। বৃষ্টিতে তাঁর ঘরের মেঝের একাংশে মাটি সরে গেছে, হেলে পড়েছে ঘরটি।
আবদুর রাজ্জাক (৪৫) বলেন, বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসে অসংখ্য ঘরবাড়ি বিলীন হয়। তারপরও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে কম টাকায় সরকারি পাহাড়ের এক খণ্ড জমি কিনে ঘরটি বানিয়েছেন তিনি।
কক্সবাজারে পাহাড় কেটে এ পর্যন্ত কত ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে, তাতে কত লোকজন বসতি করছেন, সরকারিভাবে এই পরিসংখ্যান কোথাও নেই।
তবে পরিবেশবাদী বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের দাবি, জেলায় প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট–বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি।
বাড়িগুলোর মধ্যে ১ থেকে ৩ তলাবিশিষ্ট পাকা বাড়ি আছে প্রায় ২ হাজার, আধা পাকা টিনের বাড়ি ৮ হাজার এবং অবশিষ্ট বাড়িগুলো বাঁশের বেড়া, টিন ও ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে তৈরি।
- ভারী বর্ষণ শুরু হলে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় কখন প্রাণহানির খবর কানে আসে: জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার
গত জানুয়ারিতে এই সব পাহাড়ে মাসব্যাপী জরিপ করে এমন পরিসংখ্যান তৈরি করেছে পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’।
সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, শহরের প্রায় ৩ হাজার একর আয়তনের ছোট–বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার ঘরবাড়ি। এসব ঘরবাড়িতে বসবাস করছেন তিন লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা।
এনভায়রনমেন্ট পিপল–এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, গত ১২ বছরে শহরের ফাতেরঘোনা, বাঘঘোনা, লাইটহাউস, সাত্তারঘোনা, ইসুলুঘোনা, রাডার স্টেশন, ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, খাজা মঞ্জিল, জিয়া নগর, পাহাড়তলী, বাঁচামিয়ার ঘোনাসহ ছোট–বড় ৫১টি পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। অবৈধভাবে তৈরি ঘরবাড়িগুলোর ৯০ শতাংশ পাহাড়ের মালিকানা বন বিভাগের।
রাশেদুল মজিদ বলেন, ৬৬ হাজার ঘরবাড়ির মধ্যে পাহাড়ধসের অতি ঝুঁকিতে আছে ৬ হাজার ৮০০টি, যেখানে বাস করেন ২৬ হাজার মানুষ। পাহাড়ের চূড়া কেটে সমতল করে, কিংবা পাহাড়ের ঢালু কেটে বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে। ভারী বর্ষণে ভূমিধস কিংবা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানির ধাক্কায় এসব ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। গত ১২ বছরে শতাধিক পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ৬ জন সেনাসদস্যসহ ৯৮ জনের।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, সৈকততীরের প্রায় ১৫ একরের একটি পাহাড় (ডিসি পাহাড়) এত দিন অক্ষত ছিল। সম্প্রতি বৃষ্টি শুরু হলে ভূমিখেকোরা সেই পাহাড়টিকে কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ওই পাহাড়ে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে।
ব্যাপক হারে পাহাড় নিধন চলতে থাকায় গাছপালা উজাড়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলেন, পাহাড় নিধন বন্ধ এবং অবৈধ ঘরবাড়ি উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না
গত সোমবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টের উল্টো দিকে সরকারি লাইটহাউস পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, সবুজ পাহাড়ের ঢালু কেটে তৈরি হচ্ছে কয়েকটি টিনের ঘরবাড়ি। দক্ষিণে আরেকটি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। উত্তর পাশের রাডার স্টেশন পাহাড়, হিলটপ সার্কিট হাউস পাহাড় কেটেও তৈরি হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে গত দুই বছরে এসব পাহাড়ে ২৫০টির বেশি অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তবু পাহাড় নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত কয়েক বছরে পাহাড় কেটে ১০-১২ হাজার অবৈধ স্থাপনা তৈরি হলেও দুই বছরে তাঁরা উচ্ছেদ করেছেন মাত্র ২০টি ঘর।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলম বলেন, পাহাড় কাটার বিপরীতে গত এক বছরে বন বিভাগ ৫০-৬০টি মামলা করেছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাঁচজনকে। নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও পাহাড় নিধন এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
পরিবেশ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টির সময় সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাহাড় নিধন ও অবৈধ স্থাপনার নির্মাণকাজ চলে। তখন ঝড়–বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুর্গম পাহাড়ে হেঁটে অভিযান পরিচালনা করা কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পাহাড়ের বসতবাড়ি থেকে লাখো মানুষকে উচ্ছেদ করতে হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান আয়তন ৩২ দশমিক ৯০ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৌরসভার লোকসংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার হলেও বর্তমানে তা প্রায় ৪ লাখ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে আসা ব্যক্তিরাসহ প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস এ পৌরসভায়। বাসাবাড়ির ভাড়াও অন্য জেলা শহরের তুলনায় তিন গুণ বেশি। তাই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে অনেকের নজর সরকারি পাহাড়ের দিকে।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারী লাখো মানুষকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। মাথা গোঁজার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়ায় পাহাড় থেকে জোরপূর্বক কাউকে উচ্ছেদও করা যাচ্ছে না।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ভারী বর্ষণ শুরু হলে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় কখন প্রাণহানির খবর কানে আসে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কয়েক দিন আগেও বিভিন্ন পাহাড় থেকে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী লোকজনকে সরিয়ে আনা হয়েছিল।
/প্রথম আলো/ সিবেজে
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-